সীমান্তের গারো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা নদীটির নাম সোমেশ্বরী। নদীটি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর সীমান্ত দিয়ে। জেলার দুর্গাপুর থেকে জারিয়া, বাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে কংস নদে। একসময় নদীর দুই পাড়ের জেলেদের জীবিকার প্রধান উৎস ছিল সোমেশ্বরীর মাছ। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক পর্যটক আসতো। পর্যটন শিল্প থেকেও আয়ের একটি অন্যতম উৎস ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের।
কিন্তু বর্তমানে মরতে বসেছে সোমেশ্বরী। ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বালু পড়ে ভরাট হয়ে গেছে নদীর তলদেশ। এখন সামান্য ঢলে উপচে পড়ে নদীটির দুই কূলে। বালি পড়ে নষ্ট হয়েছে দুই পাড়ের চৈতাটি, বড়ইকান্দি, কুড়ালিয়া, ফান্দা, ধানশিরা, খড়স, ডাকুমারা, ভবানীপুর, থাউসালপাড়া, আগাড়, রানীখং, তিনআলী, আত্রাখালীসহ অন্তত ৫০টি গ্রামের ফসলি জমি। উচ্চ আদালতের একটি রিটের কারণে প্রায় আড়াই বছর ধরে বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। আর এতেই এই অবস্থা।
অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বিরল প্রজাতির মহাশোল মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর জন্য খ্যাতি ছিল পাহাড় কন্যা সোমেশ্বরীর। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ে জন্ম সোমেশ্বরীর। উত্তর-পূর্ব দিকে দূরে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে চলে গেছে গারো পাহাড়ের সারি। নিরিবিলি পাহাড়ি প্রকৃতির কোলজুড়ে এককালে ছুটে যেত স্বচ্ছ সলিলা সোমেশ্বরী।পর্যটনও আয়ের একটি অন্যতম উৎস ছিল স্থানীয় বাসিন্দাদের। পাহাড় থেকে নেমে আসায় সোমেশ্বরীর খরস্রোত বহু শতবর্ষ ধরে বয়ে আনত বালু আর নুড়িপাথর। প্রতিদিন প্রায় ৪১ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হতো এ নদী থেকে। নদীর বিভিন্ন জায়গায় ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হতো। উত্তোলনকৃত ভেজা বালু দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সরবরাহ করা হতো।কিন্তু বর্তমানে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে নদীটি। গত বছর অসময়ে বন্যায় অন্তত ১২ শতাধিক পাকা/আধাপাকা ও কাঁচা বাড়ি ঘর ভেঙে গেছে। নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় গত বছর আশ্বিনের বন্যায় দুর্গাপর-কলমাকান্দাসহ কয়েকটি উপজেলার অন্তত ৬০ হাজার কৃষকের উঠতি রোপা আমন ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
সম্প্রতি নদীটি ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে ড্রেজার নেই, আগের মতো বাঁশের মাচায় বালু-পাথরের ছাঁকনি, স্তূপ স্তূপ বালু কিছুই নেই। নদীটি ভবানীপুর, চৈতাটিঘাট, শ্মশানঘাট, শিবগঞ্জঘাট, বিরিশিরি, কেরনখোলা, গাওকান্দিয়া, ফারংপাড়া সীমান্ত এলাকাসহ বেশ কিছু জায়গায় গিয়ে দেখা গেছে, নদীটির কোথাও কোথাও হাঁটু বা এর কম বেশি পানি রয়েছে। হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় কোনো মরুভূমি এটি। আসন্ন বর্ষায় আবারও নদীর তলদেশ ভরে যাওয়ার আশংকার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন। নদীর পূর্বপাড় থেকে যতদূর চোখ যায়, এখন আর এটিকে নদী মনে হয় না। তবে পশ্চিম পাড় থেকে নদীতে পানি দেখা যায়।
নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০০৫ সালে। সোমেশ্বরী নদীর প্রায় এক হাজার ৯১৪ দশমিক ৩৪ একর জায়গাজুড়ে পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেওয়া হয়। ভবানীপুর এলাকা থেকে দুর্গাপুর শ্মশানঘাট, শ্মশান ঘাট থেকে চৈতাটি ঘাট, দুর্গাপুরের বিরিশিরি সেতু থেকে কেরনখোলা বাজার, চৈতাটি ঘাট থেকে গাওকান্দিয়া, বাঞ্জাইল থেকে উত্তর শংকরপুর এ পাঁচটি বালুমহাল ইজারা দেওয়া হয়। সবশেষ শত কোটি টাকার রাজস্ব পেত সরকার। কিন্তু উচ্চ আদালতের নির্দেশে তা বন্ধ করা হয়। এরপর নদীটি আরও ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
সোমেশ্বরী নদীর বালুমহাল ইজারার শর্তাবলিতে বলা হয়েছিল, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনের ধারা অনুসারে পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোনো মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ বালু উত্তোলন করা যাবে না। বলা হয়েছিল, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ ও পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে হবে। নদীর ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য, জলজ প্রাণী বা উদ্ভিদ বিনষ্ট হলে বা হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বালু উত্তোলন করা যাবে না। এসব মেনে বালু উত্তোলন করার শর্তে বালু উত্তোলনে বাধা নেই।কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টানা দুই দশকের বেশি সময় ধরে নদীর বিভিন্ন অংশে পাঁচটি বালুমহাল ঘোষণা করে ইজারা দেয় জেলা প্রশাসন। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা বারবার নদীটি ইজারা নিয়ে নিয়ম বহির্ভূতভাবে শত শত ‘বাংলা ড্রেজার’ বসিয়ে বালু তোলা হত। নদী থেকে প্রতিদিন তুলে নেওয়া হতো হাজার হাজার ট্রাক বালু, নুড়িপাথর আর কয়লা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অপরিকল্পিত বালু তোলায় সোমেশ্বরীর শাখানদী আত্রাখালীর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এলাকার শত শত বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, সেতু, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়ক। ওই সড়কে বালুবাহী ট্রাকচাপায় প্রতিবছর গড়ে ২৫ জনের প্রাণ হারানোর ঘটনা ঘটে। দিনরাত ড্রেজারের উচ্চ শব্দে নদীর দুপাড়ের বহু মানুষের শ্রবণে সমস্যা দেখা দেয়। নদীর সুস্বাদু মহাশোলসহ বহু প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে। জেলেরা মাছ ধরতে না পেরে পেশার পরিবর্তন করেন। বিরিশিরি এলাকার পর্যটকেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ২৮ জানুয়ারি জেলা প্রশাসন ১৪৩১ বঙ্গাব্দের জন্য নদীতে বালুমহাল ইজারার দরপত্র আহ্বান করলে ইজারার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে ১২ ফেব্রুয়ারি সম্পূরক আবেদন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি দরপত্র সংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্থগিত করেন হাইকোর্ট। এরপর থেকে বালুমহাল ইজারা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।নদীর বিরিশিরি সেতু সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওই অংশে প্রায় ৪০০ মিটার প্রস্থ নদীটির ৩৫০ মিটার অংশই ধু-ধু বালু। আর মাঝখানের ৫০ মিটার অংশে হালকা পানি গড়িয়ে যাচ্ছে। কথা হয় স্থানীয় থিউফিল রেমার (৫৬) সাথে। তিনি বলেন, ‘অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার শুকনা সময় নদীডাতে একটু পানি আছে মনে হইতাছে। অহন বালু না তোলনে আমরার লাইগ্যা বালা হইছে। আগে বালুর ড্রেজার আর ট্রাকের লাইগ্যা অতিষ্ঠ থাকতাম। বালু উত্তোলন বন্ধ থাকলে এবং খনন করলে নদীটি নিজ বেগে ছুটবে। তখন সহজেই নৌকা চালানো যাবে।’
স্থানীয় কয়েকজন পরিবেশকর্মী ও কৃষক বলেন, সরকারের নিয়ম মেনে বালু উত্তোলন করা উচিত। অথবা নদীটি খনন করতে হবে। তাতে নদীর প্রবাহ ঠিক থাকবে। ফসলি জমি নষ্ট হবে না। নদীকে রক্ষা করার দায়িত্ব সরকারের। নদীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। হারিয়ে যাওয়া মহাশোল মাছের বাসস্থানে পরিণত করতে হবে। পাহাড়ি ঢলে এ নদীতে অনেক বালু আসে। বালু হয়ত তোলা প্রয়োজন। পরিবেশ ধ্বংস না করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে নদীর বালু উত্তোলনে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। নদীর নাব্যতা ঠিক রাখতে যতটা প্রয়োজন, ততটুকু বালুই উত্তোলন করতে হবে। সেজন্য বিশেষজ্ঞদের দিয়ে জরিপ করে বিজ্ঞানসম্মত ড্রেজার দিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বালু তোলা যেতে পারে। তিনি বলেন, দুই দশক ধরে বালুখেকোরা ইজারা নিয়ে শত শত ড্রেজার বসিয়ে নদীতে অপরিকল্পিতভাবে বালু তুলেছে। নদীর স্বাভাবিক স্বাস্থ্য নষ্ট করেছে। যেনতেনভাবে বালু উত্তোলন ও লুটপাট করে নদীর সর্বনাশ করেছে। এখন বালু উত্তোলন না হওয়ায় আবার বালুতে ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদী। নদীটি পরিকল্পিতভাবে খনন দরকার।তিনি আরও বলেন, এই নদীতে স্বচ্ছ পানি ও সারা বছর প্রচুর স্রোত থাকত। বড় বড় নৌকা চলত। প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম, তখন বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই নদীর টানে বাড়িতে আসতাম। তাদের নিয়ে নদীর বিখ্যাত মহাশোল মাছসহ প্রচুর মাছ শিকার করতাম। এখন আর কিছুই নেই।
নেত্রকোনার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারওয়ার জাহান বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু তোলায় নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ হারিয়ে গেছে। কিছু কিছু স্থানে পলি জমে ভরাট হয়ে আছে। এসব সমস্যা সমাধানে একটি সমীক্ষা করা হচ্ছে। এরইমধ্যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, আদালতের নির্দেশে সোমেশ্বরী নদীর বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেকে মাঝেমধ্যে বালু উত্তোলনের চেষ্টা করে থাকে। তখন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জেল-জরিমানা করা হয়। প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
বাংলাস্কুপ/প্রতিনিধি/এনআইএন